
মেহেন্দিগঞ্জ টাইমস নিউজ ডেস্ক//
দুই পা আর দুই হাত দিয়ে উবু হয়ে হাঁটছেন রুবেল হোসেন (৩৫) নামে এক প্রতিবন্ধী যুবক। কারো কাছে এভাবে হাঁটা দেখা বেশ অস্বস্তিকর মনে হলেও ওই যুবককে বাধ্য হয়ে হাঁটতে হয়। কারো কাছে হাত পেতে চলা আর ভিক্ষাবৃত্তি করা যে একটি ঘৃণিত পেশা এবং কাজ করে খাওয়াটা যে সম্মানের সে কথা সবাইকে স্বরণ করিয়ে দিলেন মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলীমাবাদ ইউনিয়নের গাগুরিয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী রুবেল হোসেন।
হাতের উপর ভর দিয়ে চার পা ওয়ালা প্রাণীর মতো হাটতে হয় তাকে। পায়ে নয় হাতে জুতা পড়ে হাঁটতে হয় তাকে।
দিনরাত পরিশ্রম করেও দু’বেলা দুমুঠো ভাত নিয়মিত জোটে না তার। তবুও ভিক্ষা করছেন না। সংসারে অভাব দেখে দুই সন্তান রেখে স্ত্রী চলে গেছে।
আর্থিক দৈন্যদশা ঘোচাতে বাড়ির নিকট বটতলা নামক বাজারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানই একমাত্র ভরসা তার। সকালে কোনো দিন না খেয়ে বা আধাপেট খেয়েই ছুটে আসেন নিজের ভাড়া করা চায়ের দোকানে। দোকানে দিনশেষে বেচা বিক্রির টাকা হিসেব করে দেখেন ৪-৫শত টাকা বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে লাভ হয় ৬০-৭০ টাকা। তাদের ৬ জনের জীবন সংসার চলে অনাহারে-অর্ধাহারে। পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
এ বিষয়ে রুবেল হোসেন বলেন, আমি ৬বছর বয়সে পঙ্গু হয়ে যাই। ২৮ বছর ধরে পঙ্গু হয়ে উপর হয়ে চলাফেরা করি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বাদ নেই, শুধুমাত্র দুটি সন্তানের জন্য বেঁচে থাকা। সবাই বলে আমাকে ভিক্ষা করতে। আমি বলেছি প্রয়োজনে মরে যাবো তবুও ভিক্ষা করবো না। আমি পরিশ্রম করে টাকা কামাইতে চাই। আমার বাবা মা দরিদ্র। দোকানে চালান দিতে পারে না। মালামাল কম হওয়ায় বেচা বিক্রি কম হয়। আমার নিজের কোন ঘরবাড়ি নেই। বাবার জরাজীর্ণ ভাঙ্গাচুরা ঘরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করি। যে ঘরে বৃষ্টি আর রোদ অবাদে আনাগোনা করে। ঘরটি মেরামত করার মত অর্থ ও নাই। ভিক্ষা নয়, ব্যবসা করে বাঁচতে চাই। অভাব দেখে দুই সন্তান রেখে আমার স্ত্রী চলে গেছে। একদিনও বসে থাকতে পারিনা অভাবের তাড়নায়। ’
রুবেল হোসেন এর বাবা দিদারুল ইসলাম মোল্লা বলেন, আমার ছেলে রুবেল হোসেন ৬ বছর বয়সে সানি পাতিক জ্বরে প্রতিবন্ধী হয়ে যায় । অনেক চিকিৎসা করিয়েছি ভালো হয়নি। ২৩ বছর বয়সে ছেলেকে বিবাহ করাই। দু’টি সন্তান রেখে বউ ছেলেকে ছেড়ে চলে যায়। ছেলেকে বলেছি ভিক্ষা করতে কিন্তু ছেলে বলে বাবা প্রয়োজনে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাবো তবুও অন্যের কাছে হাত পাতবো না। অনেক কষ্ট করে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান করে দিয়েছি। সে থেকেই ৩৫ বছর বয়সেও সেই পঙ্গুত নিয়ে জীবিকার তাগিদে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
মা নিলুফা বেগম বলেন, আমার ছেলে এবং মেয়ে দুইজন প্রতিবন্ধী। তাদের খাওয়া দাওয়া করতে কষ্ট হয়। ছেলে রুবেল হোসেনকে বলি ভিক্ষা করতে কিন্তু সে ভিক্ষা করবে না, সে বলে প্রয়োজনে মরে যাবো। তবুও ভিক্ষা করবো না। অহন আমরা চালান ছোতাও দিতে পারি না। কি করে খাইবে। আমরা কয়দিন বাঁচবো। দিন রাতে টেনশন করি আমরা মরে গেলে দুই প্রতিবন্ধী সন্তানের কি অবস্থা হবে। দুটি নাতি রেখে বউ চলে গেছে।
তার ৪র্থ শ্রেনী পড়ুয়া মেয়ে সুমাইয়া বেগমকে
স্কুলে যাওয়া হয় কি না প্রশ্ন করা হলে, তার ছলছল চোখে বলে, স্কুল গেলেও খুব কম। বাবার সঙ্গেই সারা দিন থাকতে হয়। তাকে ছাড়া তার বাবা অচল। বাবাকে সাহায্য করতে যতই পরিশ্রম করুক না কেন সুমাইয়ার কষ্ট হয় না।
সমাজকজাকির খান বলেন, প্রতিবন্ধী রুবেল হোসেন এর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তার পাশে সমাজের বৃত্তবান এবং সরকারের দাঁড়ানো উচিত। ভিক্ষা একটি ঘৃণার কাজ। ভিক্ষাকে সবাই ঘৃনা করে। রুবেল এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
ইউপি সদস্য মোঃ ইব্রাহিম খান বলেন, প্রতিবন্ধী রুবেল হোসেন সমাজের চোখ খুলে দিয়েছে। সে ব্যবসা করে খেতে চায়। ভিক্ষার পক্ষে না। তাকে অনুসরণ করলে দেশ ভিক্ষুকমুক্ত হয়ে যেতো।
মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রিয়াজুর রহমান বলেন, আমি জানতে পেরেছি প্রতিবন্ধী রুবেল হোসেন ভিক্ষা করে নয় পরিশ্রম করে বাঁচতে চায়। তার কথা শুনে আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছি। আমাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ঘর সুন্দরভাবে নির্মাণ করার জন্য টিন এবং টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। দুটি সন্তানের ভবিষৎতের জন্য তার দোকানে মালামাল তুলে দিবো।
Leave a Reply